সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড়ো তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ মন্দির, সুপ্তধারা ঝর্ণা ও সহস্রধারা ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের রামগড়-সীতাকুন্ড সংরক্ষিত বনের সীতাকুন্ড ব্লকের ক্ষয়িষ্ণু বনাঞ্চলের ১৯৯৬ একর এলাকা জুড়ে প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, নৈসর্গিক শোভা বৃদ্ধি ও জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য ২০০১ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম স্থাপন হয়। এটি বাংলাদেশের প্রথম ইকোপার্ক, যা ২০০১ সালের ১৭ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়।
এটি দেশের অন্যতম একটি ইকো-ট্যুরিজম স্পট। প্রতিবছর এ পার্কে ০৩ লক্ষাধিক পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চল এক সময় জীববৈচিত্র্যের হট স্পট হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির বাড়তি চাপে বাড়তি চাপে বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদরাজি ও প্রাকৃতিক প্রাচুর্য হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায়, পাহাড়ি বনাঞ্চলের ক্ষয়িত প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের লক্ষ্যে এ পার্কটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশে ইকো-ট্যুরিজম সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বন্যপ্রানী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এ বোটানিক্যাল গার্ডেন (উদ্ভিদ উদ্যান) ও ইকোপার্ক নিম্নরুপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
‘উদ্ভিদ উদ্যান’ অর্থ কোন এলাকা যেখানে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহকে সংরক্ষণ করা হয় অথবা অন্য আবাসস্থল হতে এনে শিক্ষা, গবেষণা, জিনপুল (Gene-pool) উৎস সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনা করা হয়।
অপরদিকে ‘ইকোপার্ক’ অর্থ উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও নয়নাভিরাম দৃশ্য সম্বলিত এলাকা যেখানে পর্যটকদের চিত্তবিনোদনের সুযোগ-সুবিধাধি সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা করা হয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের অর্থায়ন:
প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় : ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা (১ম পর্যায়)।
প্রকল্প মেয়াদ : ১৯৯৯-২০০০ সাল হতে ২০০৩-২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছর (১ম পর্যায়)
প্রাক্কলিত ব্যয় : ৪ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা (২য় পর্যায়)।
প্রকল্প মেয়াদ : ২০০৫-২০০৬ সাল হতে ২০০৯-২০০১০ সাল পর্যন্ত (২য় পর্যায়)
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের আয়তন :
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের আয়তন প্রায় ১৯৯৬ একর। এর মধ্যে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিমাণ ৪০৫.০ হেক্টর এবং বাকী অংশে গড়ে ওঠেছে ইকোপার্ক। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত আরো ০.৬২ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হইয়াছে।
ভূ–প্রকৃতি ও জলবায়ূ : বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কটি নিচু, মধ্যম ও উঁচু পাহাড় সমন্বয়ে গঠিত। পাহাড়গুলো উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত । নিচু পাহাড়ের উচ্চতা ১৫ থেকে ৮০ মিটার এবং উঁচু পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৫০-৩৬৫ মিটার। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা ৪১০ মিটার। পাহাড়গুলো প্রধানত স্ট্যান্ড-স্টোন ও শেল দ্বারা গঠিত। ভূতাত্ত্বিকভাবে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের তথা সীতাকুন্ডের পাহাড়গুলো গারো পর্বতমালার অংশবিশেষ। এ অঞ্চলের জলবায়ু আর্দ্র উষ্ণমন্ডলীয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের অবস্থান :
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ রিজার্ভ ফরেস্ট এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চিরসবৃজ বনাঞ্চলে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কিঃমিঃ উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেল পথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। চট্টগ্রাম হতে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে পাহাড়তলী সিটি তোরণ, কাট্টলী, বার আউলিয়ার পবিত্র মাজার শরীফ হয়ে কুমিরা অতিক্রম করতে পূর্ব দিকে চোখ পড়বে সুউচ্চ পাহাড়ের উপর চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরটি, যার পাদদেশে গড়ে ওঠেছে সীতাকুন্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। সীতাকুন্ড উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ফকিরহাট বাজার সংলগ্ন মহাসড়ক চন্দ্রনাথ শিব মন্দির সড়কের সংযোগস্থলে রক্ষিত সাইনবোর্ড রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পরিচিতি ও দিক নির্দেশনা। এটি দেখে যে কোন পর্যটক চন্দ্রনাথ মন্দির সড়ক ধরে অনায়াসে এগিয়ে গেলে মাত্র আটশত মিটার পূর্বে রাস্তার উভয় পার্শ্বে খেঁজুর ও অন্যান্য গাছের সারি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান ফটকে।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের বর্ণনা :
উঁচু নিচু নির্জন পাহাড়, হরিণ, ভালুক, বানর হনুমান ও খরগোশের মত বিচিত্র বন্যপ্রাণীর সমাহার পাখ-পাখালীর কলরব, প্রবাহমান প্রাকৃতিক ঝর্ণা, মনোমুগ্ধকর চিরসবুজ বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ ইকোপার্কটি সত্যিই অতুলনীয় । পাশে ফৌজদারহাট সমুদ্র সৈকত, সাগরের নীল জলরাশি, গাড় সবুজ ম্যানগ্রোভ বনসহ সাগড় বেষ্টিত হাতিয়া সন্দীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন ইকোপার্কটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সারাদিনের ক্লান্ত সূর্য তার সমস্ত দিনের কঠোর সোনালী কিরণকে স্নিগ্ধ মোলায়েম করে পর্যটকদের বিদায় জানিয়ে রুপালী পিন্ডে পরিণত হতে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে জানাতে ধীরে ধীরে সাগরে তলিয়ে যায়। সাঁঝের পশ্চিম আকাশ তখন গোধূলীর রক্তিম আভায় তৈরি করে বোটানিক্যাল গার্ডেনে এক নৈসর্গিক পরিবেশ।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান আকর্ষণ
সহস্রধারা ও সুপ্তধারা ঝর্ণা : চন্দ্রনাথ পাহাড় হতে নেমে এসেছে সহস্রধারা, সুপ্তধারার মত প্রবাহমান প্রাকৃতিক ঝর্ণা। রাস্তা হতে সিঁড়ি বেয়ে এ দুটি ঝর্ণায় গমন করা যায়। পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এ দুটি ঝর্ণা।
চন্দ্রনাথ মন্দির : ইকোপার্কের আভ্যন্তরীণ রাস্তা ধরে গাড়িতে অথবা পায়ে হেঁটে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায়েইকোপার্কের গেইট হতে পাঁচ কিলোমিটার অভ্যন্তরে চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরে। দুইশত বায়ান্নটি সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠতে হবে। তবে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মোট ষোলশত সিঁড়ি বেয়ে শিব মন্দিরে উঠতে হয়। ফাল্গুনে যখন শিব সংক্রান্তি পূজা চলে তখন দেশ-বিদেশের বৈঞ্চব-বৈঞ্চবদের কীর্তনে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো চন্দ্রনাথ অরণ্য।
উদ্ভিদ : বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের চিরসবুজ বনাঞ্চলে ৯৬ টি প্ল্যান্ট ফ্যামিলির মোট ৪১২ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। যার মধ্যে ১৫৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১১০ প্রজাতির গুল্ম, ১১৯ প্রজাতির ভেষজ ও ২৭ প্রজাতির লতা রয়েছে। বৃক্ষ প্রজাতীসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিত প্রজাতীসমূহ অন্যতমঃ
বন্যপ্রাণী : ইকোপার্কের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মধ্যে মায়া হরিণ, বানর, হনুমান, খরগোশ, বন বিড়াল, মেছোবাঘ, বেজী, গুইসাপ, গোখরা, অজগর, বন মোরগ, মথুরা, টিয়া, পাহাড়ী ময়না, শালিক, কালো মাথা বেনে বউ, পেঁচা, প্রভৃতি অন্যতম।
অর্কিড হাউস : বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি সুন্দর অর্কিড হাউস স্থাপন করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির দৃষ্টিনন্দন কয়েকশ অর্কিড আছে।
কবি নজরুল ভাস্কর্য: ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম সফরে আসেন। ২৪ জানুয়ারি তিনি রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা- বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি এবং সাম্পানের গান। চট্টগ্রাম সফরকালে কাজী নজরুল ইসলাম ভ্রমণ করেছিলেন সীতাকুণ্ড বনাঞ্চলে। সীতাকুণ্ডের পাহাড়, সমুদ্র ও ঝরণার সমন্বয়ে সৃজিত অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধ নজরুল রচনা করেছিলেন “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ” এই অমর গান। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কে স্থাপন করা হয়েছে নজরুল ভাস্কর্য।
গহীন বন: ২০০১ সালে ইকো-পার্কটি স্থাপিত হওয়ার পর থেকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে এখানে গহীন বন সৃষ্টি হয়েছে। পশুপাখির কলকাকলিতে মুখরিত এ বনে ঘুরে বেড়াতে পর্যটকরা খুবই পছন্দ করে।
গোলাপ বাগান : ৪ টি গোলাপ বাগানে ৮০০ (আটশত) গোলাপ গাছে লাল, নীল, বেগুনী, সবুজ, গোলাপী, সাদা, কালো, মেরুন ও হলুদ ও থোকা থোকা হাইব্রিড মনোমুগ্ধকর গোলাপের সমাহার রয়েছে।
শিশু কর্ণার: ইকোপার্কে আগত শিশুদের চিত্ত বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে একটি শিশু কর্ণার।